চালের ঘাটতি ও দাম বাড়ার কারণ নিয়ে কৃষক, চালকল মালিক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি বক্তব্য দিচ্ছেন।
কৃষকরা বলছেন, ধানের বাম্পার ফলন হলেও সরকার দেরিতে কেনা শুরু করে। মিলাররা (চালকল মালিক) আগেই কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে নেন।
মিলাররা বলছেন, বাজারে চালের ঘাটতি আছে। সময়মতো শুল্ক কমোনার সিদ্ধান্ত না নেয়ায় চাল আমদানি করা যায়নি।
গবেষকদের মত, সঠিক পদ্ধতিতে ধান উৎপাদনের প্রাক্কলন না করায় সরকারের জন্য বাজার তদারকি কঠিন হয়ে পড়েছে।
নীতি নির্ধারকরা বলছেন, উৎপাদনের প্রাক্কলন সঠিক ছিল। বাজারে চালের ঘাটতি নেই।
রোববার এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘চালের দাম বাড়ছে কেন? কার লাভ, কার ক্ষতি’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে বক্তাদের মধ্যে থেকে এমন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়।
সম্প্রতি প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা করে বেড়েছে। চালের সংকট মেটাতে সরকার চাল আমদানির শুল্কও কমিয়েছে। এতে দেশে উৎপাদিত চালের যথাযথ দাম পাওয়া নিয়েও শঙ্কার কথা বলছেন কৃষকরা।
এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের নয়টি জেলা (গাইবান্ধা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, মেহেরপুর, নীলফামারী, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম) থেকে ৪০ জন কৃষক, কৃষাণি এবং কৃষি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এই সংলাপে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
তারা বলেন, মিল মালিকরা আগেই ধান কিনে মজুত করে রাখেন। ফলে চালের দাম বাড়লেও কৃষক তার সুফল পায় না। উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে হয়। এ কারণে কৃষক ধানচাষ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তা ছাড়া সরকারের ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় ছোট কৃষকরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কম দামে মিল মালিকের কাছে ধান বিক্রি করতে হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক কৃষি খাতে সরকারের বিভিন্ন ভর্তুকি ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, এই সব সুবিধা কৃষকপর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকারের বিশেষ মনোযোগ রয়েছে।
চ্যানেল আই পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ বলেন, সরকারি গুদামে ছোট কৃষকদের ফসল সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলে কৃষককে আর অল্প দামে ফসল বিক্রি করতে হবে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইস্টিটিউটের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী শাহাবুদ্দিন বলেন, সরকারের বর্তমান খাদ্যশস্য মজুত পর্যাপ্ত নয়। এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
বিআইডিএস সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষক অনেক আগেই কম দামে ধান বিক্রি করে দেয়। ফলে বাজারে চালের দাম বাড়লেও, কৃষক লাভবান হয় না।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, সরকার প্রকৃত কৃষকের থেকে চাল না কিনে মিলারদের থেকে কিনছে। কৃষক উপকৃত হচ্ছে না। মিলারদের ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মজুতদারির কারণে বাজারে চালের অপর্যাপ্ততা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
কাজী সাজ্জাদ জহির বলেন, প্রতিবছর বাম্পার ফলনের পরেও চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। সরকারকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্রয় কেন্দ্র করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে চাল কিনতে হবে।
বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বলেন, মিলাররা মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকদের কাছ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায় ধান কিনেছেন।
ধানের বাম্পার ফলনের কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, এই মৌসুমের শুরু থেকেই সরবরাহ কম ছিল।
বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম বাবু বলেন, সঠিক সময়ে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত না নেয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আমদানি করা যায়নি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির চাল উৎপাদনের ভুল প্রাক্কলন নিয়ে অন্য বক্তাদের মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। বলেন, উৎপাদনের প্রাক্কলন সঠিক ছিল। খাদ্য সংকটের আশঙ্কাও নেই।
তবে আলোচকরা আগামী বোরো ধানচাষের পরবর্তী সময়ে খাদ্য পরিস্থিতিকে নজরদারির মধ্যে রাখার পরামর্শ দেন। তা ছাড়া বর্তমানে চালের বাড়তি দাম যেন উৎপাদকের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করার কথা বলেন।
বক্তারা কৃষক, কৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন’ গঠনের পরামর্শ দেন। এই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্ষেপণ ও স্বল্প-মধ্য মেয়াদে দাম নির্ধারণ করা সহজ হবে, বাজার সংকেত পাবে, নীতি নির্ধারকরা পদক্ষেপ নিতে পারবেন এবং গবেষণাকে কার্যকরভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে।
এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ধান উৎপাদনের সঠিক প্রাক্কলন অত্যন্ত জরুরি। এই প্রাক্কলনের ওপর ভিত্তি করেই নীতি নির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কখন চাল আমদানি করতে হবে, আর কখন হবে না।
তিনি আরও বলেন, ধান-চাল মজুত করার সক্ষমতা কম হওয়ায় কারণে বেশির ভাগ সময়ই সরকারের পক্ষে বাজার প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না।